Showing posts with label ছোটগল্প. Show all posts
Showing posts with label ছোটগল্প. Show all posts

Friday, October 5, 2012

এক পশলা বৃষ্টি মেখে

ফাল্গুনি মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত -'গল্পগুচ্ছ'বাংলা ছোটগল্পের ই পত্রিকা
তে প্রকাশিত। লিঙ্কটি নিচে দেওয়া হল--
http://galpogucchho.blogspot.in/2012/10/blog-post_3873.html

এক পশলা বৃষ্টি মেখে

বিজয় কুমার দাস


সরে যাওয়া ওড়নাটা টেনে ঠিক করে নেয় ঝিমলি তার দৃষ্টি এখন সামনের উত্তুঙ্গ ল্যাম্পপোষ্টটার দিকেকি রকম মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। দেখে হিংসে হয়। এক ঝলক দমকা হাওয়ায় এলোকেশ উড়ে এসে দৃষ্টিপথ ছেয়ে ফেলে।

রাত্রে খাওয়ার পর একটু শুয়ে ঘুমোতে চেয়েছিল সে। শরীরটা ভাল যাচ্ছেনা ক’দিন। একটা বিষণ্ণতার অবসাদ তাকে গ্রাস করছিল। একটু আগেই এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল। লোডশেডিং! এক টুকরো ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘে শুক্লা দ্বাদশীর চাঁদটা লুকোচুরি খেলছে। সে এসে দাঁড়িয়ে ছিল দক্ষিণ খোলা এই ঝোলা বারান্দায়।

বারান্দার পর্দাগুলো সিহরিত হচ্ছিল বাতাসের চুম্বনে, ঠিক যে রকম ভাবে সে সিহরিত হয়েছিল অমিতের প্রথম আলিঙ্গনে এবং জীবনে প্রথম পুরুষের উষ্ণ ঠোঁটের স্পর্শে। ভাবতে অবাক লাগে ঝিমলির, কি মধুর দিনগুলোই না ছিল। একসাথে স্কুল এ যাওয়া – একসাথে মেলায় ফুচকা খাওয়া – একসাথে সিনেমা হলে রূপালী পর্দার নায়ক-নায়িকাদের মধ্যে নিজেদের হারিয়ে যাওয়া – একসঙ্গে স্কুলের শতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে গান গাওয়া। কি যেন একটা গান ছিল সেটা --রবিঠাকুরের “সেদিন দু’জনে ............” , তাই হবে বোধহয়। ঠোঁটের কোণে একটুকরো হাসি ঝিলিক দেয়, চোখের কোণে একবিন্দু জল।

কথা দিয়েছিল দু’জন দু’জনকে এই ভালবাসার বন্ধন অটুট রাখার -- শেষ রক্ষা হয়নি। তবে এটা ভাবলে বোধহয় ভুল হবে, তবে কেন এখনো স্মৃতিপটে দোলা দেয় সেইসব স্বপ্নময় স্মৃতি। সেইদিনের কথাটাই ধরা যাক না, যেদিন তাকে খ্যাপানোর জন্য অমিত ও মিতালী প্রেমের অভিনয় করে জড়িয়ে ধরেছিল পরস্পর পরস্পরকে। সেদিন সে তার অমিতকে কি অপমানটাই না করেছিল – ভাবলে অবাক লাগে। শুধু কি অপমান? সেই বিখ্যাত চড়টার কথা অমিত মাঝে মাঝেই মনে করিয়ে দিয়ে ভালবাসার গভীরতার আনন্দ অন্বেষণ করত। এখন ভাবলে লজ্জা বোধ করে ঝিমলি অন্য মেয়ের সঙ্গে একান্তে কথা বললে কি হিংসেটাই না হত রিমঝিমের। এমনটা হওয়ারই কথা। তাদের সম্পর্ক নিছকই মানসিক ছিল না – শারীরিক সম্পর্ক পর্যন্ত গড়িয়েছিল। অবশেষে নিজের মতকে উপেক্ষা করে বাবার পছন্দ করা ব্যবসায়ী পাত্র বিপুলের সঙ্গে বিয়ে হয় তার। কিন্তু সম্পর্ক টেকেনি। মাত্র তিনটে মাস।

বাড়ির অবস্থাও ভাল ছিল না। মা মরা মেয়ের নিম্নমধ্যবিত্ত বাবাই ছিল একমাত্র স্বহায়। কিন্তু মেয়ের ভালমন্দ বুঝতে শেখেনি একগুঁয়ে সেকেলে জেদি বাপটা। মেয়ের বিয়ের এক মাসও হয়নি বাপটা গেল হার্ট-অ্যাটাকে। বাড়িটাও ছিল বন্ধকী। তাই স্বহায়-সম্বলহীন মেয়েটা কালের স্রোতে পা বাড়িয়ে পিছলে পড়ল জটিল ঘূর্ণাবর্তে।

এই যে কোঠাবাড়িটা তার আশ্রয়, এটাতে সে মাথা গোঁজার ঠাঁই পায় লাইনের মেয়ে রুমকির সৌজন্যে। দু’জন দু’জনকে চিনত না। প্রথম পরিচয় যবে উদ্‌ভ্রান্ত দিশেহারা রিমঝিম পুরুষের লালসার শিকার হয় একটি ট্রেনের কামরায়। বিপুলের সঙ্গে ছাড়াছাড়ির পর সে চেয়েছিল চেনাগণ্ডীর বাইরে কোথাও কোন কাজে নিজেকে নিয়োজিত করে মাথা উঁচু করে বাঁচতে। একবার ভেবেছিল অমিতের কথা। পরে অবশ্য নিজের বিবেকের কাছে আশঙ্কা ছিল -- সেও যদি ফিরিয়ে দেয়। তাই অপমানিত হওয়ার কোন মানেই খুঁজে পাইনি সে। ট্রেনের কামরায় অচৈতন্য রিমঝিমকে রুমকি নিয়ে যায় তার কোঠাবাড়িতে। সেবা-শুশ্রূষা করে, অবশ্যই নিজের স্বার্থে। রিমঝিম পরিণত হয় গণিকা ঝিমলিতে।

এখন তার কামরায় নিত্য অগুনতি পুরুষের আনাগোনা। তারা আসে, পছন্দ করে, কিনে নেয় তারপর দেহটাকে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে। ইচ্ছা অনিচ্ছার কোন মূল্য নেই তাদের কাছে। তারা শুধু মেটাতে চায় যৌনক্ষুধা। মাঝে মাঝে মনে পড়ে অমিতের কথা। প্রথম প্রেমের অভিজ্ঞতাটা বোধ হয় এমনই হয়।

হঠাৎ দরজায় আঘাতের শব্দে সম্বিৎ ফিরে পায় ঝিমলিদরজার দিকে রওনা হয় শম্বুক গতিতে। স্মৃতিগুলোকে ছুঁড়ে ফেলে দেয় সে। বাইরে রুমকির কণ্ঠ্যস্বর – “এই পোড়ারমুখী, এক নাগর এয়েছে লো, তোর সনে দিকা করতে”। গলায় ঝাঁঝালো রপ্ত স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে ঝিমলির পাল্টা প্রশ্ন, “দেখা করতে – না শরীরটাকে খেতে ?” “নোকটা নাকি কুতায় বললে চাকরী করে” – বলে রুমকি। “তা চাকরী করুক আর চুরি-চামারি করুক তা নিয়ে আমার মাথাব্যাথা কিসের?” বলে ঝিমলিনা তা ঠিক নয় – লোকটা বলল কি, তকে নাকি উ চেনে” – এক নাগাড়ে বলে চলে রুমকি। “কত মরদই তো রোজ আসে যায়, তা আমাকে চেনে তো হয়েছেটা কি?” – পাল্টা প্রশ্ন ঝিমলির।

দু’জনে আসে সরু গলি বেয়ে রাস্তার বাঁকের মুখে। লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে ঝিমলির গা যেন ছ্‌ম করে ওঠে। এই সেই তার অমিত না ? না এরকম আর তার ভাবা চলে না। এখন অন্য কারো ...............। তাছাড়া সে এরকম ভাববেই বা কেন? – বিবেক তাকে সংযমী করে।

অমিতের এবারেও বোধ হয় ভুল হল – “না এ তো সেই তার রিমঝিম নয়”। বারো বছর আগে অমিতের রিমঝিম যেমন ছিল, সে তেমন ভাবেই দেখতে চাইল। কিন্তু কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি হয়ে তার ঘাত প্রতিঘাত সামাল দিতে দিতে রিমঝিম যে ঝিমলিতে পরিণত হতে পারে এই ভাবনাটুকু ভাবতে পারেনা অমিত।

গলির হাঁটাপথ ধরে তিনজনে এগিয়ে যায় গন্তব্যস্থলে। রুমকি বলে যায়, “ভাল ভাবে সেবা করিস লো বাবুকে – দেখিস যেন মান থাকে”।

অমিত বিছানায় মগ্ন ঝিমলির দেহ নিয়ে। ঝিমলি তার ভালবাসার মানুষটাকে পেয়ে স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে হারিয়ে যায় রিমঝিমেফিকে মোমবাতির আলোয় অমিতের চোখ পড়ে ঝিমলির বাঁ স্তনের গাঢ় বাদামী বৃত্তের উপর কাটা দাগে। অমিতের মনে পড়ে যায় প্রথম মিলনের সেই স্মৃতি। রিমঝিমকে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে সুতীব্র আকর্ষণ ও সেইসঙ্গে তার স্তন যুগলে ঠোঁট চালনা করতে করতে চরম আনন্দের মুহূর্ত ও সেই সঙ্গে আবেগবশে স্তনে দাঁতের দংশন। অমিত চিনতে পারে তার রিমঝিমকে।

অমিত জিজ্ঞেস করে – “রিমঝিম তোমার এই অবস্থা কি করে হ’ল ?” এক নিমেষ দু’জনেই চুপ। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে দু’জন একে অপরের প্রতি। একটা ঢোক গিলে আমতা আমতা করে ঝিমলি বলে চলে – “কি.........কিছু বললেন ?” অমিতের মন বলল সে ঠিকই চিনেছে, ওই তো সেই উজ্জ্বল চোখ, যদিও চোখের নীচে আজ কালি। ঝিমলি প্রথমে ধরা দিতে চায়নি। কিন্তু বোধহয় এমনটায় হয়। অবচেতন মনের চেতনায় আপ্লুত রিমঝিম ধরা দেয় অমিতের কাছে।

“আগে তুমি বল তোমার স্ত্রীকে এইভাবে ঠকানোর মানে কি? তার তো কোন দোষ নেই”— কথাগুলো অস্ফুটে বের হয়ে আসে ঝিমলির মুখ থেকে।
“বিয়েই করলাম না, তাই আবার স্ত্রী কে ঠকানোর প্রশ্ন?” – অমিতের মুখ দিয়ে বেরোয় কথা ক’টি সঙ্গে দীর্ঘশ্বাস।

“এই দাগ দেখেই আমার স্বামী মানে বিপুল চৌধুরী আমাকে সন্দেহ করে। আসলে আমি ওকে ঠকাতে চায়নি – বাবার মুখ চেয়ে বাধ্য হই ওকে বিয়ে করতে। তারপর যা হবার হ’ল” – এক নাগাড়ে বলে চলে ঝিমলি

এক মুহূর্ত নিশ্চুপ থেকে ঝিমলি বলে, “তুমি বিয়ে করে সংসারী হও, এইভাবে নিজেকে শেষ করে দিও না”।
“কথাগুলো তো তোমার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য” – পাল্টা জবাব অমিতের।
--- "তাই কি সম্ভব? এই পরেও তুমি......একথা তুমি বললে?"
--- "কেন অসম্ভব? পৃথিবীতে অসম্ভব বলে তো কিছু নেই!"
--- "জানো তো তোমার কথা আমার সব সময় মনে পড়ে।"
--- "আমারও পড়ে।"

বাইরে আবার ঝম্‌ঝম্‌ করে বৃষ্টি শুরু হ’ল। অনতিদূরে রেললাইনটা ধরে একটা মালগাড়ী কু-ঝিক-ঝিক আওয়াজ করতে করতে চলে যাচ্ছে। আর এই কোঠা বাড়িটা কেঁপে কেঁপে উঠছে, হয়তো বা তাদের কথা শুনে।

অমিত, “আচ্ছা, আমরা কি পারি না সেই আগের মতো দু’জন দু’জনকে.........ইয়ে...মানে, আমরা কি বিয়ে করে সব কিছুকে নতুন ভাবে শুরু করতে পারি না? তুমি চাইলে ......”
কথাটা শেষ না হতেই ঝিমলি ধরা গলায় ঢোক গিলে বলে, “তা কি করে সম্ভব? আমি তো এখন একটা নষ্ট মেয়ে ছাড়া আর কিছুই নই”।
অমিত, “তাই যদি বল, তবে আমিও তাই। তোমার এই অবস্থার কথা শুনে আমিও উৎশৃঙ্খল জীবন বেছে নিয়েছি, বহু বেশ্যার সঙ্গে মেলামেশা করেছি, ঘনিষ্ঠ হয়েছি – কেন জানো? – আমার রিমঝিমকে খোঁজার জন্য। আজ আমি আমার সেই হারিয়ে যাওয়া রিমঝিমকে পেয়ে আর হারাতে চাই না”।

এরপর দু’টি শরীর মিশে যায় এক হয়ে। শুধু শরীর নয় মনও।

বাইরে সুপুরি গাছের সারি নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক পশলা বৃষ্টি মেখে। 

                              ....................................




© Bijoy Kr Das. All Rights Reserved.
Unauthorized use or reproduction for any reason is prohibited.